বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১১



 মা কে চাই মায়ের লাশ কে নয়


মায়ের হাতের কোমল পরশে হঠাৎ ঘুম ভাঙল নাফিসের। কি রে বাবা উঠবি না নাকি? মা জানালার পর্দাটা সরাতেই সকালের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ে চোখে মুখে। আড়মোড়া দিয়ে আবার ঘুমিয়ে যাই নাফিস। মা'র কাঁসির শব্দে পড়িমড়ি করে উঠে পড়ে নাফিস। মা তোমার কাঁশিটা কি আবার বেড়েছে নাকি? কতবার বললাম আব্বুর সাথে ডাক্তারের কাছে যাও। আমি ছোট মানুষ তো তাই তুমি আমার কোন কথাই শোন না। দেখ আমি কত্ত বড় হয়ে গেছি? দেখ? দেখ? নাফিস একথা বলতে বলতেই মা আবার কাশতে শুরু করল। দাঁড়াও আমি আজই আব্বুকে বলছি। আব্বু... আব্বু...

           আব্বু আসার আগেই নাফিজা এসে পড়ল। কি হলো এমন চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিস কেন ? দেখ না আপু আম্মুর কাঁশিটা আবার বেড়েছে। আব্বুকে বল না আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। হ্যাঁ আম্মু নাফিস ঠিকই বলেছে এবার তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে । তোরা এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন ? আমার কিচ্ছু হয়নি। মানুষের একটু আধটু কাশি হতে পারে না। দেখি না আর কটা দিন। তাছাড়া এখন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মতো এতো টাকাই বা তোদের আব্বুর কাছে কই। আজ তোর আর নাফিসের স্কুলের বেতনের শেষ তারিখ। নাফিস বলে উঠলো আমার বেতন দেয়া লাগবে না। তুমি আব্বুর সাথে ডাক্তারের কাছে যাও।

          অনেক পণ্ডিতি হয়েছে আই এবার খেয়ে নে স্কুলের সময় হয়ে গেল। নাফিস কে আগে দাও ওর পি.এস.সি প্রস্তুতি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আমার একটু দেরি হলেও সমস্যা হবে না। তোর আব্বুটা আবার কোথায় গেল। সে খাবে না নাকি। আমাকে দেখলে তো আবার তার গা জ্বলে। কি পাপ যে করেছি তার কাছে ! আমার আর এসব ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় দুচোখ যেদিকে যাই সেদিকে চলে যাই না হয় অন্য কিছু একটা করে ফেলি। শুধু পারি না তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তোরা মাতৃহারা হয়ে যাবি তাই। আম্মু তুমি আবার ...।

           খাওয়া ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলি কেন আবার তোরা। নাফিস মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে আম্মু কোথায় যাবে তুমি ? আমাকে নেবে না ? কি করে নেব বাবা সব জায়গায় কি নেয়া যায় ? নাফিস বাপ আমার আমি যদি দুরে কোথায় হারিয়ে যাই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না বাবা ? তোর তো আরেকটা আম্মু আছেই সেই তোদের দেখা শোনা করবে। নাফিস কেঁদে ফেলল, না আমি কারো কাছে যেতে পারব না। আম্মু তুমি আবার শুরু করলে। তুমি না খুব খুব খারাপ আম্মু। এসব বলে আমাদের শুধু কষ্ট দাও কেন? নাফিজা বলল।

           নাফিস কে স্কুলের কাপড়-চোপড় পড়িয়ে বিদায় দিয়ে নাফিজাও স্কুলে রওনা দিল। কিছুক্ষণ বাদে মোকাদ্দেস মানে নাফিসের বাবা ফিরল। তা কোথায় ছিলেন এতক্ষণ ? বাড়িতে যে এতো কাজ থাকে সে হিসাব আছে। কোন হিসাবী মানুষ কি এভাবে বাড়ি ছেড়ে দিনের পর দিন থাকতে পারে। আর আপনার আবার বাড়ির হিসাব কি ? আপনার তো আরেকটা বাড়ি-সংসার হয়েছে। আমার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। বাড়িতে যে দুটো ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের পড়া-শুনার খরচ আছে সে হিসাব কি আপনার আছে।

          ঐ ফকিন্নির বেটী বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই তোর এতো হিসাব-নিকাশ কেন ? আমার ছেলে-মেয়ের হিসাব আমি করবো। তোর এতো হিসাব কেন ? আর একবার যদি সংসারের হিসাব আমাকে দেখাতে আসিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন। দরকার হয় তোকে খুন করে সারাজীবন জেলে কাটাব। এমনিতেই আজ আমার মাথা গরম। মাথা গরম করাবি না কিন্তু। সংসারের হিসাব করলেই তোমার মাথা গরম হয়ে যায় না। সংসারটা কি খালি আমার একা। আমার হয়েছে যত যন্ত্রণা। আল্লাহ্‌ আমার মরণও তো করে না। সারাদিন মদ খাওয়া, জুয়া খেলা আর বাড়িতে এসে মাথা গরম করা বুঝি না মনে করেছ ? এতো বড় কথা দেখিতো বেটী তোর একদিন কি আমার একদিন।

            নাফিস ক্লাসে পড়া-শুনা নিয়ে ব্যস্ত বাড়ির কথা আর মনে নেই কিন্তু নাফিজার মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। পড়া-শুনায় কিছুতেই মন বসছে না। হঠাৎ ক্লাসের ঘণ্টার শব্দে বুকের মধ্যে ছনাৎ করে উঠলো। কোন কিছুই ভালো লাগছে না তার। এমন সময় এক স্যার এসে বলল, নাফিজা বই-খাতা নিয়ে বাইরে এসো। মুহূর্তে নাফিজার মনটা উথাল-পাতাল করতে লাগল। অজানা শঙ্কা কাজ করতে লাগল তার মনে। ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল স্যার কিছু হয়েছে নাকি? স্যার বললেন তেমন কিছু না তোমার মায়ের শরীরটা নাকি একটু খারাপ। স্যার শম্পাকে ডেকে বলল তুমি ওর সাথে যাও। ওরা বেরোনোর পরই স্কুল সেদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করলেন প্রধান শিক্ষক।

           এদিকে নাফিসকে স্যার ডেকে বললেন তোমার চাচা এসেছেন তোমাকে নিতে আজ তোমার ছুটি। ছুটির কথা শুনেই নাফিসের মার কথা মনে পড়ে গেল। তাহলে তো স্যার ভালোই হলো মার শরীরটা আজ ভালো না এখনই মার কাছে যেতে পারব। কথাটা শুনার পর স্যারের চোখ দুটো ছলছল হয়ে গেল। স্যার ছোট্ট নাফিসের মাকে নিয়ে কষ্টের কথা চিন্তা করে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

            নাফিসের দাদা যিনি খুব ছোট কালে খুব সখ করে ছেলের বউ করে এনেছিলেন নাফিসের মাকে। তাই সে তাকে মেয়ের মতোই ভালবাসতেন। মা বলে ডাকতেন। সে আবার খুব ধার্মিক মানুষ। বছরের অর্ধেকটা সময় ধর্ম প্রচারে বাইরে বাইরে থাকেন। তাই সব সময় নাফিসদের খোঁজ-খবর রাখতে পারেন না। তার কাছেও সেদিন হঠাৎ একটা ফোন আসল যে আপনাকে এখনই একবার বাড়িতে আসতে হবে। কারণ জানতে দেয়া হলো না। তার মনেও এক অদৃশ্য শঙ্কা বিরাজ করতে লাগল। কি হতে পারে বাড়িতে? ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। তার বুকের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল। সারা শরীর ঘামতে লাগল। হৃদ কম্পন হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে আরম্ভ করলো। হাত-পা অবশ হয়ে যেতে লাগল। সব কিছুকে এলো মেলো মনে হতে লাগল।

            সবে মাত্র বাস থেকে নামলেন দাদা। ঠিক তখনই একজন এসে বললেন চাচা আপনার বাড়ির খবর শুনেছেন নাকি? দাদার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে বাবা আমার বাড়িতে? কেন আপনার নাফিসের মা আজ সকালে মারা গেছে শোনেন নি? আপনাকে বলেনি কেউ? শোনামাত্র দাদা হতভম্ব হয়ে গেলেন শুধু একবার বললেন, কি? তারপর কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলেন উন্মাদের মতো। তার মস্তিষ্কে প্রচণ্ড রক্তক্ষণের কারণে তার এক পাশ অবশ হয়ে গেল। কথা অস্পষ্ট হয়ে গেল। চলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। পরিচিত অপরিচিত কাউকেই আর ঠিকমত চিনতে পারলেন না। পাগলের মতো বিলাপ শুরু করলেন। যা আর আমৃত্যু স্বাভাবিক হলো না।

            নাফিসের স্কুল গ্রামেই হওয়ায় নাফিজার আগেই বাড়ি পৌঁছল সে। আঙিনায় প্রবেশ পথে প্রচণ্ড ভিড় দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারল না সে। সবাই থ মেরে বসে আছে। চাপা কান্নার শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। চির চেনা আবাস যেন অচেনা মনে হচ্ছে। হাতে থাকা ললিপপ অজান্তেই মাটি পড়ে গেল বুঝতেও পারল না নাফিস। এক মহিলা বুকে জড়িয়ে বিলাপ করতে লাগলেন, এ দুধের শিশুটার মুখের দিকেও চেয়ে দেখলি না একবার। কি করে পারলি এটা ? নাফিস কিছু না বুঝেই কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করল। বারান্দায় মাকে চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ছুটে গেল মায়ের কাছে। কি হয়েছে আমার আম্মুর। আম্মু....আম্মু...। কথা বলছে না কেন আমার আম্মু ? আমার আম্মুর কি হয়েছে ? তোমরা আমার আম্মুকে কথা বলতে বল। আমার ক্ষুধা লেগেছে খাবার দিতে বল আমার আম্মুকে?

              বাড়ির থমথমে পরিবেশ দেখে নাফিজার মনের শঙ্কাটা আরো বেড়ে গেল। শম্পা নাফিজাকে এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। নাফিজা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোরা বলছিস না কেন কি হয়েছে। তোরা কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস নাকি ? তোরা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা আর নিস না। তোরা না বললেও আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। বাড়ির উঠানে ঢুকতেই এক গাদা লোক বিলাপ করছে আর কান্নার ধ্বনি কানে আসতে লাগল নাফিজার। এক চাচি এসে নাফিজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল তোর মা আর নেই। তোদের আর আদর করে খেতে ডাকবে না। কাঁদিস না মা আমরা তো আছি। এখন থেকে আমরাই তোদের আম্মু। চল দেখবি না মায়ের মুখটা শেষবারের মতো। নাফিজার মুখ থেকে আর কোন কথায় বেরোল না। চোখ বয়ে অঝরে নোনা জল ঝরতে লাগল। তার সব কথা যেন অশ্রু হয়ে ঝরতে লাগল। কোন ভাবেই তাকে তার মায়ের কাছে নেওয়া গেল না। তার দৃষ্টি যেন দূরে কোথাও। সে তার মাকে দেখতে চাই। মায়ের লাশকে নয়। লাশ দিয়ে সে কি করবে। তার মাকে চাই। আর কিছু নয়


প্রজাতি
লেখক : সোহেল রানা
          রাস্তার মাঝে প্রচণ্ড ভিড় দেখে হঠাৎ- থেমে পড়লামভিড় গলে বিষয়টা বুঝতে বেশ সময় লাগলগাড়ির হর্ন আর মানুষের চাপে বিষম যন্ত্রণাযানজট সামাল দিতে ট্রাফিকের নাভিশ্বাস অবস্থাতবু যেন কেউ কাউকে কিছুই বলতেও পারছে নাউঁকি ঝুঁকি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম ঘটনাটা কি? একজন বলল সম্ভবত একটা দুর্ঘটনাসামনে এগোতেই জানলাম একটা বাচ্চা মেয়ে নাকি অঝরে কাঁদছেকেন কি কারণে কেউ বলতে পারছে নাতাকে কেউ সেখান থেকে সরাতেও পারছে না
ক্লিক ক্লিক শব্দে বুঝতে পারলাম সাংবাদিকও জুটে গেছেকাছে গিয়ে দেখলাম একটি পাঁচ কি ছয় বছরের মেয়ে কেঁদে চলেছে অবিরামজিজ্ঞেস করলাম কে তুমি ? কি নাম তোমার ? বাবার নাম কি ? বাসা কোথায় ? আধো আধো গলায় সব প্রশ্নের একটাই উত্তর- প্রজাতি! মুশকিলটা হল এখানেইসবাই ধরে নিলো মেয়েটার নাম প্রজাতিআর কিছুই সে বলে নাশুধু-ই কাঁদে
           কাঁধের ব্যাগ হাতড়ে স্কুলের নাম আর একটা ছোট্ট চিরকুটে তার মায়ের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলঅগত্যা বাঁচা গেলকিছুক্ষণ পর সকুলের ম্যাডাম ও খানিক বাদেই হন্ত-দন্ত হয়ে মেয়েটির মা আসলে বিষয়টা জানা গেলমেয়েটার নাম অনতিপ্রজাপতি তার ভীষণ প্রিয়প্রজাপতির গল্প শোনা আর আঁকা তার প্রধান কাজআজ ক্লাসে ম্যাডাম যখন প্রজাপতির ছবি আঁকতে বলে তখনই তার মনে পড়ে আসার সময় রাস্তার পাশে একটি প্রজাপতিকে দেখেছিল পাখনা ভাঙা অবস্থায়অনেক কেঁদে কেটেও নির্দয় স্কুল-ভ্যান চালকের অনুমতি পায়নি শুশ্রূষা করারবোঝাতে পারেনি ম্যাডামকেও তার মনের কষ্টটাতাই তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে টিফিনের জন্য
           অবশেষে অপেক্ষার প্রহরটি আসতেই আর দেরি করেনি সেরাস্তা পারাপারের ভয় বা ম্যাডাম কিংবা ভ্যান চালকের হুমকি কোন কিছুই আর তাকে আটকাতে পারেনিকিন্তু ততক্ষণে যে তার প্রজাতির অবস্থা আশঙ্কাজনকহাফাতে হাফাতে যখন পৌঁছল অন্তি ততক্ষণে তার প্রিয় প্রজাতি পৃথিবীর মায়া যে ত্যাগ করেছে সেটা তার অবুঝ হৃদয় বুঝতে পারল নামা যখন দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে কোন কিছু চেয়ে প্রার্থনা করত অন্তি মাকে বলত এটা করলে কি হয় আম্মু ! মা তখন তার গালে চুমু এঁকে বলতেন বড় হলে বুজবি রে মাআজ সে কখন যে তার অজান্তেই কতবার আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে তা নিজেও বুঝতে পারেনি সে
         এ্যাম্বুলেন্স এ্যাম্বুলেন্স করে চিৎকার করেছেকেউ শোনেনি তার অসহায় আর্তনাদকেউ বোঝেনি তার ছোট্ট মনের ব্যাকুলতাছেলে-মানুষের ছেলে খেলা হিসেবে অট্টহাসি হেসেছেকেউ কেউ আবার বলেছে আহা রে বাচ্চা মেয়েটা রাস্তার মাঝে খেলা করছে দেখার কেউ নেইবাবা মা'য় বা কেমনঅনেকেই ভাবছে সে হয়তো বাবা- মাকে হারিয়ে কাঁদছেএকজন সচেতনতা দেখাতে পুলিশকে খবর দিয়ে খুব গর্ববোধ করতে লাগলেনপুলিশ তার চিরায়ত ঘটনা আড়াল করার স্বভাব অক্ষুণ্ণ রাখলো টেলিভিশন সাংবাদিকদেরও হাজির হতে বেশি সময় লাগল নাএতো মানুষের মধ্যে একজন ও অনতির কষ্টটা বুঝতে পারল নাযে যার পেশাদারিত্বকে ভেবেছে ঘটনা কি তদন্তের চিন্তা করেছে কিন্তু তার ছোট্ট মনের ভালোবাসার জায়গায় কেউ প্রবেশ করতে পারেনিআজ অন্তি প্রথমবারের মতো রাস্তায় নামল আর অনুভূতিহীন পৃথিবীকে দেখল


1 টি মন্তব্য: